এখন এই চৈত্রের রাতে যে হাওয়া বইছে , তার মতো বিষণ্ণ বস্তু আগে দেখিনি । তারাপদ রায়ের লেখায় পড়েছিলাম, তাঁর বাল্যকালে বাংলাদেশের গাঁ-গঞ্জে, চোত মাসে, কাঁথা মুড়ি দিতে হত রাতে। ভোররাতে রীতিমতো শীতল বাতাস বইত। সে সব দিন আর নেই। গাছ-পালা মুড়িয়ে কেটে, পুকুর বুজিয়ে, দিঘি ভরে দিয়ে – দুনিয়া জুড়ে যে হত্যা যজ্ঞ শুরু হয়েছে , তার ফলাফল আমাদের ভাগ্যে জুটেছে। মার্চ থেকে শুরু হচ্ছে তাপপ্রবাহ। জঙ্গল নিধনের খেসারত দিচ্ছি – দাবদাহের কবলে পড়ছি – এ সি মেশিনের রমরমা বাড়ছে। ধ্বংস হচ্ছে পক্ষীকুল। গরমের গোড়ার দিনগুলোতে মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে সান স্ট্রোকে। দিকে দিকে নির্বিচারে কুড়ুল চালাচ্ছে অপরিণামদর্শী, লোভীরা। ইমারত নির্মাণ হচ্ছে জলাভূমি মেরে ফেলে। আর অসৎ লোকে এই জলাভূমি বোজানো জমিতেই প্যান্ডেল বেঁধে প্রকৃতি রক্ষার সভা করছে। এদিকে মাসগুলো তাদের বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলছে – তীব্র গ্রীষ্মের পাগলা ঘন্টি বেজে চলেছে সারা বছর। শীতের দিনের হিম গায়েব হয়ে যাচ্ছে দ্রুত। শীতকাল ছোটো হয়ে আসছে। যশোর রোডের পাহারাদার যে সব বৃক্ষ সমূহকে নির্মূল করেছি আমরা, তাদের দীর্ঘশ্বাসের কালোতে বাতাসে বিষের পরিমাণ বাড়ছে। তবু শেষ অব্দি, আদালতের হস্তক্ষেপে সেখানকার কিছু গাছকে বাঁচানো যাবে – এমন সংকেতে প্রাণের ইশারা দেখা যাচ্ছে, তবু।
তথাপি, চৈত্র-এর রিক্ততা অসীম। বাতাসে জলীয় বাস্প কমে যাচ্ছে এবং রাত বড়ো হয়ে হ্রাস পাচ্ছে তারা দেখার অবকাশ। নক্ষত্রের দিন আর যে কতকাল বসন্ত রজনীর মুকুটে থাকবে, তা কেউ জানে না। তাই কালপুরুষের রাজত্বও অনিশ্চিত। সন্তানকে নিয়ে গ্রীষ্মের রাতে, ছাদে উঠলে – সপ্তর্ষি মণ্ডল দেখার যে নিজস্ব আনন্দ বাঙালির পরম্পরাজাত ঐতিহ্য, তাও আজকাল বিরল হয়ে আসছে। বায়ু দূষণের কবলে পড়ে, শহরের নাভিশ্বাস ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আবছা হয়ে আসছে আমাদের দূরের দৃষ্টি। ভবিষ্যতের করুণ অবস্থাকে অস্বীকার করে, আমরা নেমে যাচ্ছি কলুষময়তার অভিমুখে।
দূষণ যে কেবল পরিবেশে ছড়াচ্ছে তা নয় – ছড়াচ্ছে আমাদের মনে, আচরণেও। সামাজিক মাধ্যমে চোখ রাখলে, অস্থির লাগে। সেখানে মৃত্যুর ছবিতে লোকে প্রোফাইল অনুসরণের অনুরোধ রাখছে – প্রিয়জনের শবের সঙ্গে সেলফি পোস্ট করছে- শ্মশান থেকে চলছে লাইভ। আর কুবাক্যের সুনামীতে দিশেহারা হচ্ছি আমরা। যা খুশি লিখে যাচ্ছে সবাই – স্থানকালপাত্র বিবেচনা না করেই মিথ্যে-অর্ধ সত্য মন্তব্যে ভরে যাচ্ছে দেওয়াল। দুর্ঘটনা, ধর্ষণ, গণহত্যার খবরে হাসির ইমোজি দিচ্ছে নেটিজেনরা। যুক্তিবাদী গলা-তোলা মেয়েরা তকমা পাচ্ছে ‘বেশ্যা মাগী’ হিসেবে। প্রতিবাদী ছেলেদের অবলীলায় লোকে ‘খানকির ছেলে’ বলে দিচ্ছে।
এসব দেখে আমাদের বমি পাচ্ছে খুব। তপ্ত দিনের গান ভুলে গিয়ে আমরাও বাক্যে অস্ত্র শানাতে লেগেছি। হাহাকার করছে হারিয়ে যেতে বসা গাজনের মাঠ। মাঠ বিলুপ্ত হয়ে বহুতল উঠছে। সেখানে মেলায় ডি জে বাজছে – নাচ হচ্ছে চটুল ভঙ্গিতে।
ক্রমশ আবহাওয়ার অসুখে আটকে যাচ্ছে কালবৈশাখী নামের জীয়ন কাঠি। তীব্র গরমকালের সে এক এবং অন্যতম ওয়েসিস নির্মাতা। তার মতিগতি পালটে যাচ্ছে বলে, আগুন নিভছে না। দেশান্তরের দাবানল এসে হাজির হচ্ছে আমাদের বঙ্গেও। জ্বলছে আকাশ- মাটি – বায়ু। আজকাল আর কেউ চোত-পালনে সন্ন্যাসী হয়ে মাধুকরী করে পাওয়া অন্ন পাক করে, মিলিয়ে আসা বিকেলের দিকে তাকানোর ফুরসত পায় না। নেটফ্লিক্স, মল, ডিসকাউন্ট, রিলের ঘেরাটোপ পার করে দেখা হয় না ‘প্রহর শেষের আলোয় রাঙা’ সর্বনাশকে। এখন সর্বনাশের মানেটাও বদলে গেছে। বদলে গেছে চৈত্র সেলের চরিত্র। সারাবছর কেনাকাটার মেলা চলছে অনলাইনে। অফলাইন নিয়ে মাথা ব্যথা কমে গেছে বলে, হকার্স কর্নার শূন্য। অবশ্য মলের ঠান্ডা হাওয়ায় লোকের অভাব নেই।
দিন বদল নিয়ে অভিযোগ চিরকালীন হলেও ইদানীং বড্ড বেরঙিন লাগে সব। রমজানের চাঁদের কিরণেও অন্ধকার কমে না। এ ধর্মের লোক, ও ধর্মের লোকের হাত ধরার বদলে ইট ছুঁড়তে চায়। আজ বাংলাদেশ থেকে প্যালেস্তাইন – নির্বিচারে হত্যালীলা চলছে । এবং রক্তের দাগ লাগা শাড়ি পরে, আমরা যাচ্ছি নতুন বছরের দিকে। পৃথিবীতে যুদ্ধ লেগেছে। শবের আসলে কোনো ধর্ম হয় না, জাঁহাপনা। আপনারা যাঁরা যুদ্ধ করেন, তাঁরা যুদ্ধে যান না। মরি আমরা। ইতিহাস সাক্ষী, আমরা, কেবল আমরাই চিরকাল দাবার সেই ঘুঁটি, যাদের জন্য কোনো রাষ্ট্রেরই কখনো কিস্যু যায় না, আসেও না। আমাদের মরাই নিয়তি। ফলে বাধ্যত, পহেলা বৈশাখকে এই লড়াই-বুলেটের আবহেই এবার স্বাগত জানাচ্ছি আমরা। নতুন বছরে পৃথিবী শান্তি পাক – বায়ু শুদ্ধ হোক – কোমলতর বন্ধু করতলসহ জীবন এগিয়ে যাক ন্যায়ের পথে।
শুভ ১৪৩২!