নতুন বছর যখন আসে তখন পুরোনোটাকে আমরা অনাদরে ফেলে রাখি বা তাকে বাক্সবন্দি করে রাখতে ভালোবাসি। পুরানোকে বাতিল করে নতুনকে গ্রহণ করার মধ্যে আমাদের এক অনাবিল আনন্দ ও অনুরাগ। রবীন্দ্রনাথ তাই বলেছেন, ‘এসো হে বৈশাখ...’ পুরোনো বছরের সব আবর্জনা দূর হয়ে যাক।... মুছে যাক সব গ্লানি, মুছে যাক জরা… অগ্নিস্নানে দেহে প্রাণে শুচি হোক ধরা.. নতুন বছরের প্রভাতে নতুন সঙ্কল্প নিয়ে এগিয়ে যাবার স্পর্ধাই হল প্রকৃত মনুষ্যত্ব ও ব্যক্তিত্বের প্রকাশ।
যাযাবরের চোখ দিয়ে আমরা যেদিন থেকে দিল্লিকে দেখতে বা যাচাই করতে শুরু করেছি তখন থেকে দিল্লি আমাদের কাছে ব্যুরোক্রাটিক পদক্ষেপের শহর , যেখানে সরকারি চাকরিওয়ালাদের দাপট প্রবল। সারা দেশে অর্থনৈতিক দুর্যোগের ফলে চাকরি-বাকরি পাওয়া যখন আজকাল দুষ্কর হয়ে উঠেছে তখনও দিল্লি বাঙালিদের একটা বড়ো আশ্রয়, কারণ একটু ধর্তব্যের মধ্যে চাকরিবাকরি পেতে গেলে এখন দিল্লি ছাড়া গতি নেই। এবং দিল্লির সব পাড়াতেই এখন বাঙালিদের উপস্থিতি প্রবল এবং নতুন বছরের উৎসব থেকে শুরু করে নানা অনুষ্ঠানের নানা তোড়জোড়।
দিল্লির কথা বলবার আগে সারা ভারতে পয়লা বৈশাখ পালনের ব্যাপারে সামান্য দুচার কথা বলে নিলে এ দেশের বিচিত্র জীবনযাত্রার মধ্যে ঐক্যসূত্রটা কোথায় তার কিছুটা হদিস পাওয়া যাবে। কলকাতায় নববর্ষ বলতে বোঝায় সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন এক জীবনে পদার্পণ। গান ও উৎসবে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে বাঙালি। তেমনি শুধু কলকাতা কেন, বিভিন্ন রাজ্যে নিজেদের কৃষ্টি ও ঐতিহ্যকে মর্যাদা দিয়ে যারা আধুনিক জীবনযাত্রাকে আপন করে নিয়েছে, সেখানেও পয়লা বৈশাখ পালিত হয় 'পেঙ্গল' বা 'পূর্ণথান্ডু' অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। বাঙালিদের মতোই তারা নতুন বছরে ঘরদোর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে, নদী থাকলে নদীতে বা বাড়িতে স্নান করে নতুন জামাকাপড় ও শাড়ি পরে তারা উৎসবে যোগ দেয়। তার আগে মন্দিরে গিয়ে পরিবারের কল্যাণ ও আশীর্বাদ প্রার্থনা করে। ছেলেমেয়েরা নতুন সাজসজ্জায় আনন্দমুখর হয়ে বড়োদের প্রণাম করে আশীর্বাদ ভিক্ষা করে। খাওয়া-দাওয়া মাছ-মাংস বা বিরিয়ানি কদাচ নয়, তারা এই দিনটায় নিরামিষাশী। কেরালায় নতুন বছর 'বীশু' বা ভীশু ( বৈশাখ থেকে ভীশু হয়েছে) উৎসবের দিনটায় পুজোর ঘরটাকে সবাই নতুনভাবে সাজিয়ে-গুছিয়ে নেয়। তারপর পুজোর সরঞ্জামের মধ্যে থাকে একটা আয়না পানপাতা, দক্ষিণা শুধু টাকাপয়সা নয়, সোনার মুদ্রা এবং ফলমূল। প্রদীপ জ্বালার পরে বাড়ির লোকেরা চোখ বন্ধ করে পুজোর ঘরে গিয়ে বসে এবং পরিবারের শান্তি ও কল্যাণ কামনা করে। এরকম আলাদা আলাদা রাজ্যে আলাদা আলাদা সব নিয়ম। পাঞ্জবে যেমন 'বৈশাখী’। শিখেরা পবিত্র নদীতে স্নান সেরে গুরুদোয়ারে গিয়ে ভক্তিমূলক গান গায় কিংবা গান শোনে। আসামের 'বিহু'গান ও নাচ তো খুবই জনপ্রিয়। ওড়িষাতে পালন করা হয় 'পন সংক্রান্তি' বা পয়লা বৈশাখ। তেমনি মহারাষ্ট্রে 'গুডি পারওয়া' এবং জাম্মু ও কাশ্মীরে 'নভরেহ'।
নানা রাজ্যে পয়লা বৈশাখ উৎসব পালনের প্রেক্ষিতে এবার আমরা দিল্লির কথায় আসি। দিল্লি একটা বিরাট কসমোপলিটান শহর। এখন যাযাবরের দেখা দিল্লি একেবারে পালটে গেছে। বিশেষ করে চিত্তরঞ্জন পার্ক হবার পরে দিল্লির সাংস্কৃতিক জীবনে আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে। আগে ছিল পুজোর সময় নানা ধরনের নাটক করার উদ্যোগ আর ওই সময়কার প্রচলিত রীতিনীতি অনুযায়ী মনোরঞ্জনের জন্য যা-কিছু অনুষ্ঠান। এখন চিত্তরঞ্জন পার্কে পয়লা বৈশাখে ভোর পাঁচটা থেকে বৈশাখ পর্ব শুরু হয়ে যায়। চিত্তরঞ্জন পার্কের ৭ থেকে ৮ হাজার বাঙালি পয়লা বৈশাখের প্রথম প্রভাতে সূর্য-অর্ঘ্য দিয়ে দিনটাকে স্বাগত জানান। চিত্তরঞ্জন পার্কের কালীবাড়িতে এই সূর্যার্ঘ্যের আয়োজন করা হয়। মেয়ে-বউরা একদিকে লাইন করে দাঁড়ায়, আলাদা লাইনে পুরুষেরা। সবার হাতে একটা দোনা-- তাতে থাকে গঙ্গাজলের সঙ্গে ফুল বা ফুলের পাপড়ি। সূর্য ওঠার আগে পুরোহিতমশাই মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে সবাইকে মন্ত্র পাঠ করান: জবাকুসুম সঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিমম্। ধ্বন্তারিং সর্বপাপঘ্ন প্রণতোহস্মি দিবাকরমা।... পুরুতমশায় শ্লোকের অর্থ বাংলায় বুঝিয়ে বললে মনে মনে সাবাই যেন পয়লা বৈশাখের প্রথম প্রভাতে দিবাকরকে প্রণাম করে সর্ব পাপ থেকে মুক্ত হবার প্রার্থনা জানায় চিত্তরঞ্জনবাসীরা। তখন সোসাইটির প্রেসিডেন্ট তাঁর ভাষণে প্রতি বছর একই কথা বলেন। তাঁর বক্তব্যের সারাংশ হল আগের দিল্লি আর নেই। এখন দিল্লি একটা ক্রমবর্ধমান শহর। প্রতিদিন বড়ো বড়ো বিলন্ডিং উঠছে। আমাদের পাড়াতেও। তাদের ভাড়াটেরা বেশির ভাগই ভিনদেশি। আপনাদের প্রত্যেককে অনুরোধ জানাই, চিত্তরঞ্জন পার্ক চিরকাল একেবারা বাঙালি পাড়া হয়ে থাকবে এটা যেমন দিল্লির মতো শহরে আশা করা যায় না, তেমনি আমাদের দেখতে হবে এখানকার অবাঙালিরা যাতে বাঙালিদের ছাড়িয়ে যেতে না পারে। তখন তো এই সূর্যার্ঘ্যের আয়োজন করা আর সম্ভব হবে না। যদি এরকম ক্রমাগত হতে থাকে তাহলে এই শহরে বাঙালির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য লুপ্ত হয়ে যাবে। তাই আপনাদের কাছে অনুরোধ আপানারা যখন ভাড়াটে খুঁজবেন, বা ফ্লাট বিক্রি করবেন, যেন দেখেন যতদূর সম্ভব বাঙালি হয়।
দিল্লিতে সাহিত্য ও সংস্কৃতির সবচেয়ে পুরানো প্রতিষ্ঠান হল বেঙ্গল অ্যাসোসিয়েশন। তারা প্রতি বছর পয়লা বৈশাখ পালন করে। রবীন্দ্রসংগীত, কবিতা পাঠ ও আলাপচারিতার মধ্যে দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা ও পরিশেষ। তবে এরা পঁচিশে বৈশাখটা খুব বড়ো করে আয়োজন করে সঙ্গীত আকাদেমির প্রাঙ্গণে। দিল্লিতে যত গায়ক আছেন তাঁদের আমন্ত্রণ জানায় এবং দিল্লিতে ১০/১২টি রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে তাদের সদস্যদের এবং যাঁরা রবীন্দ্রসংগীত শেখান তাঁদেরও এই পঁচিশে বৈশাখের মঞ্চে আহ্বান করা হয়। সাকাল ছটা থেকে বেলা দেড়টা-দুটো পর্যন্ত শিল্পীরা একের পর এক এক মঞ্চে উঠে গান পারিবেশন করেন। শ্রোতারা মুগ্ধ হয়ে শোনেন।
বাদ বাকি যেসব প্রতিষ্ঠান আছে, যেমন রিডিং রোড কালীবাড়ি, নয়ডা কালীবাড়ি, গ্রেটার নয়ডা কালীবাড়ি, দক্ষিণ দিল্লি কালীবাড়ি--এরা প্রত্যেকে কালীবাড়ির হলে বা তাদের প্রাঙ্গণে পয়লা বৈশাখে ছোটোখাটো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। নয়ডা কালিবাড়ির কর্তৃপক্ষ জানালেন, মন্দিরের ভক্তরা সারাদিন ধরে পুজো দিতে থাকেন। সন্ধ্যাবেলা আরতির পর একটি করে পঞ্জিকা ও লাড্ডু বিতরণ করা হয়। তারপর শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। গ্রেটার নয়ডা কালীবাড়ির শারদীয়া সাংস্কৃতিক সমিতি মেসেজ করেছে যে তারা বড়ো করে অনুষ্ঠান করবে ১৯ এপ্রিল সাড়ে ছয়টায়। শুভ নববর্ষ ১৮৩২--এসো হে বৈশাখ। বিশেষ আকর্ষণ সঙ্গীত ও নৃত্যগীত। এছাড়া নানবিধ খাদ্যের স্টলও দেওয়া হবে। তেমনি স্বরকা কালীবাড়িতেও এই ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। দ্বারকার বাঙালিদের আরও একটা ক্লাব আছে--বঙ্গদর্শন ক্লাব। সেখানকার সেক্রেটারিও জানালেন যে তাঁরা শুভ নববর্ষে ১৯ এপ্রিল বড়ো আকারের অনুষ্ঠান করছেন।
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের মিরান্ডা কলেজের এক সিনিয়র লেকচারারের সঙ্গে কথা বলে জানলাম যে দিল্লি ইউনিভার্সিটিতে সব কলেজ মিলে একসঙ্গে পয়লা বৈশাখে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে। এভাবে সারা দিল্লির নানা কলোনিতে পয়লা বৈশাখে ছোটো-বড়ো নানারকম অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরা হয়। এখানে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন মেমোরিয়াল সোসাইটিতে রবীন্দ্রসংগীত শেখান জয়তী ঘোষ। তিনি বললেন, দিল্লিতে পঁচিশে বৈশাখ যত ধুমধাম করে পালন করা হয়, ততটা পয়লা বৈশাখ নয়, যা আমরা দেখি ও জানি। এখানে পয়লা বৈশাখের দিনটিতে ঘরে ঘরে খাওয়া-দাওয়া, গান গাওয়া ও গান শোনা বা যাকে বলে নববর্ষের সান্ধ্য-আড্ডা তাই বসে। এইভাবে সারা দিল্লিতেই সেদিন কিছু-না-কিছু উৎসব পালিত হয়ে আসছে। এবারও হবে।