পাহাড়ের কোলে ছোট্ট জনপদ। নাম তার গণ্ডাছড়া। আগরতলা শহর থেকে অনেকটা দূরে। তখন ছিল উগ্রপন্থীদের রমরমা। তারই মধ্যে বন্ধুদের সঙ্গে গণ্ডাছড়া অভিযান। তখন, মানে ২০০১ সালের মধ্য এপ্রিল, চারিদিকে আতঙ্কের মধ্যেও সেখানে উৎসবের সুর। সুন্দরী চাকমা রমণীরা মেতেছিলেন নিজেদের আনন্দে। রাতভর অনুষ্ঠান এবং খানাপিনা। সকাল হতেই আমরা, তৃষ্ণার্তরা পৌঁছে গেলাম নির্দিষ্ট বাড়ির মাটির দাওয়ায়। এক এক করে আমরা তখন বিভিন্ন বয়সী জনা কুড়ি তো বটেই। দাওয়ার পাশে কাঠের উনুনে পাঁচন তৈরির গন্ধ। যথারীতি চৈত্র বিদায়ের সকালে শুরু হল চাকমাদের হাতের জাদুতে তৈরি মদ্যপান। আহা , কী তার স্বাদ ! দিনভর এবাড়ি, ওবাড়ি ঘুরে মদ্যপান এবং সঙ্গে অবশ্যই চাকমাদের অসাধারণ লোকসংস্কৃতির ঝলক ভুলবার নয়। বহুবার তাই ছুটে গিয়েছি বিঝু উৎসবে।
হ্যাঁ, বিঝু। বিঝুও উত্তর পূর্বাঞ্চল এবং বাংলাদেশের অত্যন্ত জনপ্রিয়। চাকমা সম্প্রদায়ের মানুষ বর্ষ বিদায় ও নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে মেতে ওঠেন বিঝু উৎসবে। বসন্তের শেষ প্রহরে ‘বিঝু পাত তুরু তুর’-র সুরে চাকমা সুন্দরীরা তুলে ধরেন নিজেদের কৃষ্টি ও পরম্পরা । চাকমারা মূলত বৌদ্ধ। বর্ণাঢ্য পোশাকে চাকমা রমণীরা প্রতি বছরই পাহাড়ের কোলে পালন করেন এই উৎসব। এবারও ত্রিপুরা, মিজোরাম, মণিপুর, অসম ও অরুণাচলের পাশাপাশি বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চলে পালিত হচ্ছে বিঝুর রকমারি। চৈত্রের শেষ দুদিন এবং বৈশাখের প্রথম দিন চাকমারা বিঝুর সুরে মাতোয়ারা হয়ে ওঠেন। সঙ্গে থাকে তাঁদের বিশেষ পদ জাগোরা ও কাঞ্জি। কাঞ্জি হচ্ছে বিয়ারের চাকমা ভার্সন। আর জগোরা হচ্ছে চাকমাদের ব্রান্ডি। নিজেরাই তৈরি করেন। জাগোরা ও কাঞ্জির সঙ্গে ঘরে ঘরে তৈরি হয় পাঁচন। এঁচোর-সহ পাঁচ রকমের সব্জি তৈরি হয় হরেক শুঁটকি দিয়ে। অত্যন্ত সুস্বাদু এই খাবার যে একবার খেয়েছে সে জীবনে ভুলতে পারবে না।
আসলে মদ পাহাড়ি জনজীবনের সংস্কৃতির অঙ্গ। ত্রিপুরা ও বাংলাদেশের অন্যান্য পাহাড়ি জনপদও এই সময় মেতে ওঠেন তাঁদের উতসবে। যেমন ত্রিপুরায় গড়িয়া ও হোজাগিরি উৎসব। সেখানেও মদ ঈশ্বরকে উৎসর্গ করে ভক্তরা সেবন করেন। গড়িয়া নৃত্যও কিন্তু খুবই সুন্দর। জুমের ফসল ঘরে তোলার আনন্দে মেতে ওঠেন ত্রিপুরী সম্প্রদায়ের মানুষ।
বৈঝুও পাহাড়িদের একটি উৎসব। সমস্ত উৎসবেই থাকে নিজস্ব সুর ও ছন্দ। অসমের বড়োরা মেতে ওঠেন খেরাই উৎসবে। হিংসা বিধ্বস্ত মণিপুরও তাঁদের ঐতিহ্য মেনে এই সময়েই মেতে ওঠেন ‘সাজিবু নোংমা পানবা’ বা ‘মেইতেই চেইরাওবা’ উৎসবে। মিজোদের ‘চাপচর কুট’, খাসিয়াদের ‘শাদ সুক মিনসিয়েম’ এবং নাগাদের ‘সেক্রেনি’ ও ‘আওলিয়াং’-ও বেশ জমকালো ফসল তোলার উৎসব।উত্তর পূর্বাঞ্চলের প্রতিটি জনগোষ্ঠীরই রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি। এই সময়ে ফসল তোলার আনন্দে বহুকাল ধরে তাঁরা মেতে ওঠেন আনন্দ যজ্ঞে। বাঙালিরাও তার ব্যতিক্রম নয়। বাঙালি অধ্যুষিত বরাক উপত্যকা তো বটেই, সর্বত্র বাঙালিরাও নতুন বছরকে নিজস্ব কায়দায় বরণ করে নেন। ত্রিপুরাতে বাংলা বর্ষ বরণে আয়োজন করা হয় একাধিক অনুষ্ঠানের।
তবে সবাইকে ছাপিয়ে এক নম্বরে অসমের বিহু। অসমিয়াদের রঙালি বিহুর উৎসব চলে মাসভর। গ্রাম থেকে শহর সর্বত্রই বিহুর সুর ও ছন্দে বাঁধনহারা উচ্ছাস। সামনের বছর অসমে বাংলার মতোই বিধানসভা ভোট। তার আগে, আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহেই পঞ্চায়েত ভোট শুরু হবে। রীতিমতো সেমিফাইনাল। তবে ফাইনাল বা সেমিফাইনালকে মারো গুলি, বিহুতে মেতে ওঠেন সকলেই। অসমিয়াদের রক্তে বইছে বিহুর মাদকতা। নিজেদের কৃষ্টিকে কীভাবে লালন করতে হয় সেটা তাঁরা ভাল জানেন। তাই কার্তিকে কেতু বিহু, অগ্রহায়ণে ভোগালি বিহু আর চৈত্রের শেষ প্রহরে ভোগালি বা বহাগ বিহুর উন্মাদনা চিরকালই বেশি।
উত্তর পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন জজাতি গোষ্ঠীর মধ্যে জনসংখ্যা নিরীখে বাঙালি ও অসমিয়ারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। বাঙালিরা আবার অনেকেই ছিন্নমূল। তাই বিহুই উত্তর পূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে বড়ো উৎসব। সেই উৎসবে মাতোয়ারা গোটা অসম। এমনকী, অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে যাঁরা জঙ্গলে গিয়েছেন, স্বাধীন অসমের স্বপ্ন নিয়ে, তাঁরাও মেতে ওঠেন বিহুর সুরে। অস্ত্র হাতে কোমর দোলানোর সেই ভিডিও-ও ভাইরাল করেন তাঁরা। রঙালি বিহু বা বহাগ বিহু নামেতেই স্পষ্ট, এটা রঙ্গ বা তামাশার উৎসব। সেই রঙ্গ বা তামাশায় রয়েছে আদি ও অকৃত্রিম প্রেমের উপাখ্যান। বিষাক্ত সাপের মুখ থেকে কপো ফুল আজ আর তুলে আনতে না পারলেও প্রেমিকার মন জয়ে চেষ্টার ত্রুটি নেই অসমিয়াদের। প্রকৃতির আবাহনে তরুণ প্রজন্ম আজও ধরে রেখেছে নিজেদের পরম্পরা। সামাজিক মাধ্যম বা মুঠোফোনের ছোট্ট দুনিয়া আটকে রাখতে পারে না। তাই ‘জগৎ জুড়ি বিহুর পরব খুশি যে ছড়ায়/ বসন্তে এই বিহুর লগন উত্তল হয়ি যায়’! আর গোটা পরিবেশ গেয়ে ওঠে, ‘বিহু বিহু বুলি ওলায় অহিল...’