তালিকা

আধুনিক বাঙালির ফেভারিট লোকেশ
রমজান, বোহরী মহল্লা আর আমি


মার্চমাসে মুম্বাইয়ে প্যাচপ্যাচে গরম সহ্য করে সবে লোলাপালুজায় গ্রিনডের 'ওয়েক মি আপ হোয়েন সেপ্টেম্বর এন্ডস' চিৎকার করে গেয়ে আমার ডাক্তারতুতো বোনের বাড়ি ফিরে ফ্রিজটা খুলেছি ঠান্ডাজল খাবো বলে, ওদিক থেকে শুনলাম, ‘উঁহু উঁহু!’ এহেন বগাপুলিশের কাছে ধরা পড়ে ম্রিয়মান মুখে ফিল্টারের দিকে গ্লাস নিয়ে ঘুরতেই সুবর্ণা ওরফে বিবিসোনা বলল, ‘কালকের জন্যে তৈরি থাকতে হবে। শরীর খারাপ, গলা ব্যথা করলে চলবে না।’ ব্যাপারটা কিছু ভুল বলেনি। মুম্বাইয়ে এমনি এলেও রমজানের সময় কখনও ঠিক আসা হয়ে ওঠেনি, আর শেষবার বোহরী মহল্লা যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল আরেক বন্ধুর দয়ায়। সেবার শালিমার হোটেলের রোল এবং রাস্তার বায়দা রোটি (আমাদের মোগলাই পরোটার ভায়রাভাই) খেয়ে নূর মোহাম্মদীর চিকেন সনজুবাবা (যার রেসিপি নাকি স্বয়ং সঞ্জয় দত্তের দেওয়া) খেয়ে বেশ হতাশ হয়েছিলাম। তবে এবার সুবর্ণার সঙ্গে জুটে গেল আমার অন্য গানপাগল বন্ধু তণ্বীর, যে আমাকে তার আগের গোটা দিন লেকচার দিয়েছে যে আমি আগের বার গিয়ে যা খেয়েছি সবই ভুলভাল আর আমার উচিত ছিল তখন ওকে চেনার। এহেন বকুনি শুনে বড়োই আঁতে লাগল, তাই পরদিন সন্ধে সাড়ে সাতটা টার্গেট করে (এখানে সূর্য সাতটার আগে অস্ত যায় না) আমরা তিনজন তিনদিক থেকে এসে পৌঁছলাম বোহরী মহল্লায়।

বোহরী মহল্লা নামটা এসেছে বোহরী মুসলমানদের থেকে, যারা ১১ বা ১২ শতাব্দীতে ইয়েমেন থেকে গুজরাটে আসে। আঠেরশো সালের শুরুর দিকে বোম্বেতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রমরমা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এক এক করে ভাগ্য অন্বেষণ করতে গুজরাট থেকে আসা মানুষগুলো কিছুটা সামাজিক, কিছুটা আর্থিক আর কিছুটা সুরক্ষার খাতিরেই হয়তো কাছাকাছি থাকতে শুরু করে, আর আস্তে আস্তে গড়ে ওঠে বোহরী মহল্লা।

মুম্বাইয়ের ট্রাফিকের চাপে সাড়ে সাতটা পৌনে আটটা হয়ে গেল। ততক্ষণে সূর্য কমলা সমুদ্রের উপর বিশাল মেঘের খেল দেখিয়ে নেমে গেছে, আর সারাদিন রোজা রাখা মানুষগুলোও দুমুঠো মুখে দিয়ে আমাদের খিদমতে তৈরি। একদিকে একদল পুলিশ বেজার মুখে কেউ বসে, কেউ দাঁড়িয়ে, আবার কেউ কেউ কাছাকাছি দোকানের কাবাবচির কাজ দেখতে এতই ব্যস্ত যে হাতের খৈনি হাতেই রয়ে গেছে। আমার অবর্তমানে সুবর্ণা আর তণ্বীরের ততক্ষণে সাক্ষাৎ ও একদফা ঝগড়া নাকি হয়ে গেছে কে কী খাওয়াবে নিয়ে, তাই দেরি না করে বসে পড়লাম ইন্ডিয়ান হোটেলে। প্লাস্টিকের চেয়ারে বসতেই চটপটে এক ছোকরা লালরঙা মেনু দিয়ে গেল। মেনুতে মুরগি মটনের ছড়াছড়ি , তবে আমার টার্গেট মগজের দিকে - মানে ঘিলু। ইন্ডিয়ান হোটেলের এদিকে নাম আছে - আমার দু-তিনজন বন্ধু ভেজা তাওয়া খেতে বারবার করে বলেছিল। তার সঙ্গে তণ্বীরের অর্ডারী নানচাপ, রোল, তাওয়া গুর্দা, বায়দা রোটি আর পাও হাজির। এখানকার পাও গোয়া বা ভিয়েতনামের সঙ্গে তুলনীয় - দুধসাদা ময়দা ইস্টের গুণে ফুরফুরে বালিশের মতো ফাঁপা। উপরটা আবার হালকা মুচমুচে - বোধহয় ডিম দিয়ে ব্রাশ করেছে উপরটা, বেক করার আগে।

এইসব ভাবতে গিয়ে নানচাপ দেখলাম বাকি দুজনে প্রায় শেষ করে ফেলেছে। নানচাপ ব্যাপারটা বেশ মজার - দুটো নান রুটির মধ্যে মাংসের পুর - তবে নান যেটাকে বলে সেটা একটু ছোটো আর মোটা। ঔরঙ্গাবাদে নান কালিয়া খেয়েছিলাম, এই নানরুটি সেরকম না, বরং এর মধ্যে হ্যামবার্গার বানের প্রভাব বেশি। এরপর বায়দা রোটি, দেখলে মনে হবে মোগলাই পরোটা, তবে এর তালুক ইয়েমেনি মুর্তাবাকের সঙ্গে বেশি আছে মোগলাইয়ের থেকে - কিন্তু একটু পুদিনার চাটনির সঙ্গে খেতে খাসা। এবার হাজির হল মগজ, ওরফে ঘিলু। দেখে তন্বীর আর বিবিদেবী সোজা হয়ে বসল - দুজনেই এই বস্তু আগে চেখে দেখেনি।

এবার এখানে আমার কিছু বক্তব্য আছে - ঠিকভাবে রান্না করলে মাংস অপূর্ব হয়, আর খারাপভাবে বানালে ততটাই ত্যাজ্য। এখানে দেখলাম রাঁধুনি তাওয়াতে প্রথমে সেদ্ধ ঘিলুটাকে আলতো হাতে ছোটো ছোটো টুকরোতে ভাঙল, তারপর তাতে মেশাল মশলাওয়ালা ঝোল আর উপরে ভাসা তেল, এখানে যাকে বলে তরী। তারপর কুচোনো ধনেপাতা আর লেবু - এর বেশি কিছু সত্যিই লাগল না - পাওটাকে ছিঁড়ে একটু মগজ আর ঝোলটা দিয়ে এক কুচি শশা আর এক ফোঁটা লেবুর রস মেড়ে যখন মুখে দিলাম সেই স্বর্গীয় মুহূর্তে আমার মুখ দেখে বাকি দুজনে দেখলাম পটাপট পাও ছিঁড়ে নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরাই করতে লাগল।

দু-তিন মিনিট শান্তিপূর্ণ কাটল। তারপর পয়সা মিটিয়ে আমরা হাঁটা লাগলাম তাজ আইসক্রিমের দিকে, কারণ দ্বিতীয় রাউন্ড খ্যাঁটনের আগে আমার আবার একটু স্বাদ বদল করার অভ্যেস আছে। এই দোকানটায় আগেও এসেছি, তবে এবারে ঢুকে দেখতে পেলাম পুরনো দিনের আইসক্রিম তৈরি করার মেশিন। ১৮৮৭ সালে মান্ডভীর বাসিন্দা ভালিজি জালালজি একটা নৌকোয় করে ভেসে ওঠেন বোম্বের পাড়ে। ভিন্ডিবাজারের পেছনে প্রথমে দোকান দেন মিষ্টির, তারপর আইসক্রিম। ছোট্ট দোকানটায় গেলে দেখা যায় দেশি-বিদেশি খবরের কাগজে আর ম্যাগাজিনে ওদের নিয়ে কত লেখা। সীতাফল, রোজ ফালুদা আর আলফনসো আমের আইসক্রিম নিয়ে চার পুরুষের এই দোকানের এখনকার মালিক আমিরের সঙ্গে এমন গল্প শুরু হয়ে গেল, যে আমার আবার একটু একটু খিদে পেতে শুরু করে দিল। একটু পেস্তাবাদামের দরাদরি করে নূর মোহাম্মদীর উপরের তলায় এসির ঠান্ডায় বসে অর্ডার দিলাম সুফিয়ানী মুরগি বিরিয়ানি, চিকেন হাকিমী, শাম্মী কাবাব, নাল্লি নিহারী আর লাহোরী জিরা সোডা, মেড ইন ইন্ডিয়ার। দিব্বি মিষ্টি জলজিরার মতো খেতে। হাকিমী খেয়ে বুঝলাম দিল্লির আসলাম চিকেনের ভয় পাওয়ার কিছু নেই, তবে আমার আর্টারির আছে, কারণ মাখন আর মুরগির পরিমাপ কাছাকাছি ছিল, তাই বলাই বাহুল্য বেশ ভালোই খেতে ছিল। নাল্লি নিহারীতে একটু মজ্জা ভাসতে দেখে চামচে দিয়ে তুলে সুরুৎ করে মুখে পাচার করে ধোঁয়াওঠা সুফিয়ানী বিরিয়ানিতে চামচটা একটু চালাতেই দুধ আর কেওড়ার গন্ধে ঘর ভরে গেল। মুরগিটা তুলতুলে নরম, চালটাও ঝরঝরে আর একদম হালকা - হাতে তেল লাগল না। শাম্মী কাবাবটা বাইরে থেকে যেমন মুচমুচে ভেতরটা তেমনই নরম -- সত্যি তখন আগেরবারের কথা ভেবে নিজেকে মর্কট বলতে ইচ্ছে করছিল।

বিরিয়ানির পর আমার চিরকাল মনটা মিষ্টি মিষ্টি করে, তাই বেশি না ভেবে তাওয়াক্কাল সুইটসের ডিম দেওয়া মালপোয়া খেতে গেলাম। সামনে বেশ ভিড়, তবে বেশিক্ষণ লাগল না তিনটে সিট পেতে। দোকানের সামনে একদিকে যেমন মালপোয়া ভাজা হচ্ছে, অন্যদিকে প্যানে কুনাফা ভাজা হচ্ছে। এখানে দেখলাম কুনাফার ভেতরে নরম চিজ না দিয়ে ঘন করা মালাই দেয়। মালপোয়াগুলো বিশাল সাইজের, সঙ্গে রাবড়ি মাস্ট। ভালো করে রাবড়ি মাখিয়ে একটুকরো মালপো মুখে ফেলতেই বুঝলাম যে এরা মালপোয়া ঘিতেই ভাজে। যদিও জীবনে সবচেয়ে ভালো মালপোয়া আমি পুষ্করে খেয়েছি, তবু এটাকে দ্বিতীয় খেতাব দিতে আমার বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। এর মধ্যে বিবিসোনার আড্ডার দৌলতে একটুকরো গরম কুনাফাও মুফতে জুটে গেল, তার ভেতরের ক্ষীর বেশ ঘন, কিন্তু খুব একটা মিষ্টি না। বেরিয়ে ইদ্রিসের কোল্ড ড্রিঙ্কের দোকান থেকে সোডা খেয়ে কালী পিলি ট্যাক্সিকে বললাম, ‘চলো মেরিন ড্রাইভ!’ রাত্রিবেলা ভিড়ও নেই, হাওয়াও না, কিন্তু ট্যাক্সিতে চড়ে জানলা দিয়ে বাঁধানো বিচের পাশে আলো ঝলমলে শহরটাকে দেখতে দেখতে নিজের মনেই শেষে গুনগুনিয়ে উঠলাম, ‘শোলা হ্যায়, য়া হ্যায় বিজুরিয়া, দিল কি ডগড়িয়া, বোম্বাই নগরীয়া!’


সাবস্ক্রাইব
অবহিত করুন
guest
0 টি মন্তব্য
ভোটপ্রাপ্তি অনুসারে
নতুন থেকে পুরোনো পুরোনো থেকে নতুন
ইনলাইন প্রতিক্রিয়া
সকল মন্তব্য দেখুন
Scroll to Top