ক্যালেন্ডারে মাসটা বৈশাখ হলেও নতুন বাংলা বছরের গোড়াটা লন্ডনে শীত বিদায়ের সময়। গাছের কচি গুল্ম, ধূসর আকাশ থেকে সোনালি আভা, বরফের চাদর সরিয়ে সবুজ ঘাসের কার্পেট, প্রকৃতির রূপান্তর, বাড়তে থাকা তাপমাত্রার হালকা আদর চৈত্রের শুষ্কতা মনে পড়তে দেয় না। তবুও বাঙালি ‘শুচি হোক ধরা’ মনে রেখে আলমারি গোছায়, রান্নাঘরের চিমনি পরিষ্কার করে, খাটের কোণার ধুলো ভ্যাক্যুম করে । আর কী করে বাঙালি ? বিলেতে বঙ্গ জীবনের অঙ্গ নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময়। এসএমএস বা হোয়াটসঅ্যাপ তো ডিজিটাল পন্থা। বিলেতে বাঙালির নববর্ষ মানে কিন্তু কমিউনিটি হল ভাড়া করে দেদার আড্ডা, ভুরিভোজ আর স্টেজে আশা-লতা-কিশোর। খুব বেশি হলে গিটার হাতে জীবনমুখী । সাধারণত এই উদযাপন হয় সপ্তাহান্তে । পয়লা বৈশাখের আগে বা পরের সপ্তাহে । ঝলমলে রোদ্দুর সরে যাওয়ার পূর্বাভাস না থাকলে হল লাগোয়া খোলা মাঠে বুফে প্লেট নিয়ে বসে যায় বাঙালি ।
এ বছর সপ্তাহের শুরুর দিকে পয়লা বৈশাখ । তার পরের শনিবার লন্ডনের আপ্টন কোর্টে আয়োজিত হচ্ছে বৈশাখী মেলা । এই মেলা কিন্তু মূলত পূর্ববঙ্গের বা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বাঙালিদের উদ্যোগ । পূর্ব লন্ডন এবং পূর্ব ইংল্যান্ডের বেশ কয়েকটি অঞ্চল বাংলাদেশি অধ্যুষিত । বাংলাদেশ সৃষ্টির সময় থেকেই এ অঞ্চলে প্রবাসী বাংলাদেশিদের হাত ধরে পহেলা বৈশাখ পালন হয়। নব্বইয়ের দশক থেকে পূর্ব লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটস পুরসভার অধীনে একাধিক স্থানে বৈশাখী মেলা আয়োজিত হয় । গ্রাম বাংলার খাবার, হস্তশিল্প, ওপার বাংলার শিল্পীদের দুর্দান্ত সব শো -- সব মিলিয়ে বিলেতে বৈশাখের শুরু হত জমজমাট । ঢাকা শহরের রমনার বটমূল থেকে শুরু হওয়া মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রতিফলন দেখা যেত টেমসের ধারে ব্রিটিশ রাজধানীতে। পেটিকোট লেনের ব্রাডি আর্টস সেন্টার থেকে শুরু করে, বাংলা টাউনের ব্রিকলেন ধরে উইভার্স ফিল্ডের মাঠে থামত শোভাযাত্রা । মেলার জনপ্রিয়তা টাওয়ার হ্যামলেটস পুরসভাকে মেলার দায়িত্ব নিতে উৎসাহ দেয় । অবশ্য স্থানীয় ব্যবসায়ী এবং মেলা কমিটি পুরসভাকে এ বিষয়ে সাহায্য করে । কোভিড কালের আগে, ২০১৯ সালে টাওয়ার হ্যামলেটসের বৈশাখী মেলায় ৪৫ হাজার মানুষের সমাগম হয়েছিল । এখনকার চিত্র অবশ্য ভিন্ন । ১৪ এপ্রিল ব্রিকলেনে নটিংহিল কার্নিভ্যালকে জবাব দেওয়ার মতো শোভাযাত্রার আয়োজন হয়েছে । বাংলার শাড়ি, পিঠা থেকে বোরহানি, বাংলার বাঘের প্রতিকৃতি সহ উজ্জ্বল প্যারেডের সাক্ষী থাকবে লন্ডন । ব্রিকলেনের রাস্তা জুড়ে চলা উৎসবে খাওয়া-দাওয়া, ঢাক-ঢোল, লাল-পাড় সাদা শাড়ি, বিরাটকায় মুখোশের বন্যা--পহেলা বৈশাখ সংক্রান্ত সব ধর্মীয় বিতর্ককে নস্যাৎ করতে চলেছে । প্যারেডের লাইভ স্ট্রিমিংয়ের ব্যবস্থা থাকছে । ইস্ট লন্ডনের বিভিন্ন পাড়ায় পরবর্তী সপ্তাহে বসছে মেলা । টাওয়ার হ্যামলেটসের বিশাল আয়োজন নয়, এখনকার বাঙালি একাধিক অঞ্চলে বিভক্ত হয়ে স্থানীয় মেলার আয়োজন করে । প্রাচুর্য না থাকলেও প্রাণ থাকে উৎসবে ।
এবার আসি পশ্চিমবাংলার কথায়। লন্ডনের পশ্চিম প্রান্তে হেস্টনে ‘এসো হে বৈশাখ’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ২৬ এপ্রিল নববর্ষ উদযাপন করছে হুল্লোড় অলাভজনক সংস্থা । ছোটো থেকে বড়ো , নাটক থেকে সমবেত কণ্ঠে গান - সমস্তরকম সাংস্কৃতিক পরিবেশন থাকছে । তার সঙ্গে দেদার মধ্যাহ্নভোজ । লন্ডনের বাইরে মিল্টন কিনসের আনন্দ ক্লাব বর্ষবরণের আয়োজন করেছে ২৬ এপ্রিল । সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আর পেটপুজো--- আনন্দ ক্লাবে পাতে পড়বে ঝুরঝুরে আলুভাজা, এঁচোড়ের ডালনা, পটল পোস্ত, দই কাতলা, মুরগি কষা আর বাঙালির দুর্বলতা--- পাঁঠার কষা মাংস । ওই একই দিনে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে নবকিরণ সাংস্কৃতিক উপস্থাপনার মাধ্যমে নববর্ষ পালিত হচ্ছে। তার মানে কি বিলেতে বাঙালি নববর্ষ মানে বৃহত্তর বাঙালি সমাজের চক্রে সামিল হয়ে কব্জি ডুবিয়ে খাওয়া ? না, ব্যতিক্রম অবশ্যই রয়েছে। বার্মিংহ্যাম থেকে ‘সিটি অফ জয়’ নামক ক্লাউড কিচেন চালান ম্যান্ডি মন্ডল । তিনি জানালেন, লিড্স, ম্যানচেস্টার, কেমব্রিজ প্রভৃতি এলাকা থেকে এ সময়টা বাঙালি খাবারের অর্ডারের ঢল নামে । বাঙালির সাবেকি রান্নাকে বিলেতবাসীর টেবিলে পৌঁছন ম্যান্ডি । পয়লা বৈশাখের এক সপ্তাহ আগে, চিংড়ি দিয়ে মোচার ঘন্ট, ডাব চিংড়ি, চিতল মুইঠ্যা, ছানার ডালনার যোগান দিতে ব্যস্ত সিটি অফ জয়ের কর্মীরা । তবে এ বছর ম্যান্ডির কিচেনের বিশেষ চমক মাছের মাথা দিয়ে পুঁই ছ্যাঁচড়া । লন্ডন সংলগ্ন ওয়াটফোর্ড অঞ্চলে বাঙালি টিফিন-লাঞ্চ পরিষেবা দেন সুমিতা মুখোপাধ্যায় । তাঁর ক্লাউড কিচেন - সুমির পাকশালা । সুমিতা জানালেন, তিল পাবদা, মাছের মাথা দিয়ে বাঁধাকপি, ইলিশ পাতুরি আর চিংড়ির মালাইকারির চাহিদা সবথেকে বেশি এই নববর্ষে ।বাড়ির বাইরে না বেরিয়ে উইক এন্ডে বন্ধু বা আত্মীয়দের সঙ্গে বাড়িতেই নববর্ষের নস্টালজিয়া গায়ে মাখছে বাঙালি।
শেষপাতে মিষ্টিমুখের কথা না বললেই নয় । সিটি অফ জয়ের ক্লাউড কিচেন থেকে মিষ্টি দইয়ের হাঁড়ি পৌঁছে যাচ্ছে লন্ডনের নানা মহল্লায় পয়লার ঘরোয়া পার্টির জন্য। নববর্ষ উপলক্ষ্যে গুড়ের খাজা তৈরি করছেন কারিজ এন্ড কুলিনারি-র কর্ণধার প্রদীপ্ত দাস ।
বৈশাখের সঙ্গে বিলেতে আরেকটি বিষয় ওতপ্রোতভাবে জড়িত । তা হল আমাদের প্রাণের ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ। স্টেনসের প্রয়াস, গ্লাসগোর বঙ্গীয় সাংস্কৃতিক পরিষদ, হ্যারোর বাঙালি গ্ৰুপ--- সকলেই রাবীন্দ্রিক ভাবনায় নববর্ষের অনুষ্ঠান সাজিয়েছে । বেঁধে বেঁধে থাকা বাঙালি এই বঙ্গাব্দে দলছুটের অপবাদ ঘোচাচ্ছে ।