তালিকা

আধুনিক বাঙালির ফেভারিট লোকেশ
শোলা : ওজনে হালকা, ঐতিহ্যে ভারী


বাঙালির বিয়ে থেকে উৎসব থেকে থেকে শোলার ডাক পড়ে। শোলার মতো হাল্কা একটা জিনিস এত সব গম্ভীর এবং ওজনদার ব্যাপারস্যাপারের সঙ্গে কীভাবে জুড়ে গেল তা সত্যিই অবাক হওয়ার মতো একটি বিষয়। বিস্ময়ের এই পর্দা সরাতে হলে বাংলার শোলা শিল্পের বিবর্তনের দিকে একঝলক তাকাতে হবে।

নববর্ষের সকাল থেকেই পাড়ার মলিন মুদির দোকানগুলি থেকে দশকর্মা ভাণ্ডারগুলি শোলার সফেদ কদমফুলে অনিবার্যভাবে সাজবেই। আবার প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে দানবদলনী দুর্গার অসুর দমনের মতো গম্ভীর ব্যাপারের সময় দুর্গতিনাশিনীর হাতের আঙুলেও ঝুলবে শোলার চাঁদমালা। শোলার মুকুট পরে বিয়ের পিঁড়িতে বসে থাকা পাত্রমশাই সারাজীবন ধরে সেই মুকুটের ওজন টের পান। কালে কালে আরও নানা কাজে শোলার ব্যবহার বেড়েছে। তবুও আমাদের শোলার কথা মনে পড়ে শুধুই উৎসবের অনুষঙ্গে। শোলা বাঙালির উৎসবের এক অপরিহার্য অঙ্গ। জলজ শোলা গাছের কাণ্ড থেকেই বাংলার গ্রামাঞ্চলের মালাকার সম্প্রদায় বর-কনের মুকুট, চাঁদমালা থেকে শুরু করে প্রতিমার পিছনের চালি ইত্যাদি তৈরি করতেন। এখন মণ্ডপের আলোকসজ্জাতেও শোলার ব্যবহার বাড়ছে। সময় এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে তা থেকে তৈরি হচ্ছে মাথার টুপি থেকে মুখোশ এবং ঘর সাজানোর নানা জিনিস। দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও বাড়ছে সেসব জিনিসের কদর।

শোলা (ভারতীয় কর্ক) একটি নরম হাতির দাঁতের মতো রঙের গাছ, যা বাংলা, আসাম, ওড়িশা, তামিলনাডু, অন্ধ্রপ্রদেশের জলাজমিতে জন্মায়। শোলা পরিবেশবান্ধব, টেঁকসই এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য একটি সম্পদ -- যা শুধু বাংলার একটা গাছই নয় বরং বাংলার সাংস্কৃতিক যাত্রার এক অংশীদার। শোলা বাংলার সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও আচারের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে। শোলা গাছের কাণ্ডের নরম, মসৃণ, ছিদ্রময়, ও হালকা অংশটিকে বলে শোলা পিঠ। যা থেকে তৈরি হয় নানা সূক্ষ্ম আলঙ্কারিক সামগ্রী। পশ্চিমবঙ্গের বহু জেলার মালাকার সম্প্রদায়ের শোলা শিল্পে বিশেষ দক্ষতা রয়েছে। বাংলার প্রধান হস্তশিল্প কেন্দ্রগুলির মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগণার মথুরাপুর, পূর্ব বর্ধমানের বনকাপাসি, আলিপুরদুয়ারের ভাটিবাড়ি, উত্তর দিনাজপুরের আটঘড়া, দক্ষিণ দিনাজপুরের কুশমণ্ডী এবং বীরভূমের সুরুল।

প্রক্রিয়া
মালাকার নামে পরিচিত শোলাশিল্পীরা শোলার ডাল কেটে খোদাই করে মুখোশ সহ নানা ধরনের আলঙ্কারিক সামগ্রী তৈরি করেন। শোলা গাছগুলি তোলার পর প্রথমে কান্ডগুলিকে রোদে শুকিয়ে বাদামি করে নেওয়া হয়। এরপর কাণ্ডগুলির ভিতর থেকে সাদা অংশটি কেটে বার করে আনা হয়। তারপর সেটি পাতলা ফালি করে কাটা হয়। এবার সেই পাতলা টুকরোগুলি কেটে বানানো হয় নানা আলঙ্কারিক সামগ্রী। বিভিন্ন ধরনের জিনিস বানানোর সময় শোলাশিল্পীরা ব্যবহার করেন কাপড়, পাট, পুঁতি ও অলঙ্করণের অন্যান্য সামগ্রী। শিল্পীরা শোলা কেনেন স্থানীয় হাট থেকে। তারপর ছুরি, কাঁচি, কাটার, কমপ্রেসর, আঠা এবং স্প্রে দিয়ে রঙ করে তাঁরা তৈরি করেন শোলার সুন্দর এবং সূক্ষ্ম নানা সামগ্রী।

মালাকার
শোলা শিল্প এবং মালাকাররা সমার্থক। নির্ভুল দক্ষতা এবং নান্দনিক কল্পনার সাহায্যে মালাকাররা শোলা দিয়ে নানা ধরনের জিনিস তৈরি করেন। মালাকার সম্প্রদায়ের উৎপত্তি নিয়ে নানা মত রয়েছে। কেউ মনে করেন, আজকের মালাকাররা নবশাখ গোষ্ঠীর কারিগরদের একটা শাখা। যাদের মধ্যে রয়েছেন - কুম্ভকার, কর্মকার, মালাকার, কাংসকার, শঙ্খকার, স্বর্ণকার, সূত্রধর, চিত্রকর এবং তন্তুবায়। অনেকে বিশ্বাস করেন মালাকাররা দেবতা বিশ্বকর্মা এবং শাপভ্রষ্ট গোপ কন্যা ঘৃতাচীর সন্তান। অন্য আরেকটা মতে, মালাকাররা ব্রাহ্মণ। বেশিরভাগ মালাকারই শিবের পূজারী এবং মনে করেন তাঁরা শিবের বংশধর। শোলা গাছের আজকের স্বীকৃতি মালাকারদের নান্দনিক সূক্ষ্মতার গুণে। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় প্রায় ৫০০ জন শোলা শিল্পী রয়েছেন যাঁরা বংশ পরম্পরায় শোলার কাজ করে আসছেন। আগে মেয়েরা শোলার কাজ করতেন না, কিন্তু এখন বিভিন্ন জেলায় তাঁদের সংখ্যাও বাড়ছে। নানা এলাকার শোলাশিল্পীরা শোলার ফুল, দেবদেবীর মূর্তি, হাতি, ময়ূরপঙ্খী নৌকা, চাঁদমালা, পুতুল, ফল, সবজি, বর-কনের টোপর ও মুকুট প্রভৃতি তৈরি করেন। ধর্মীয় উৎসবের সময় দেবদেবীকে সাজানোর জন্য তাঁদের বেশিরভাগ পণ্যই কলকাতার কুমোরটুলিতে বিক্রি হয়।

শোলা পণ্য
শোলার কয়েকটি সামগ্রীর কথা আগেই বলেছি এবার এ নিয়ে একটু বিশদে বলা যাক। শোলাকে একটা শুভ সামগ্রী বলে ভাবা হয় এবং তা নির্মলতার চিহ্ন বলে প্রায়শই ব্যবহার করা হয় ঐতিহ্যবাহী অলঙ্করণের কাজে। হিন্দু বাঙালিদের বিয়েতে বর-কনের মুকুট তৈরি হয় শোলা দিয়ে। কদম ফুল খুশি ও আনন্দের প্রতীক, তা তৈরি হয় শোলা দিয়ে। উৎসব ও বিয়ের সময় তা বাঙালি বাড়ির বাইরে ঝোলে। হিন্দু দেবী দুর্গাকে পরানো হয় শোলার নানা অলঙ্কার। সর্পদেবী মনসার একটি বিশেষ বিগ্রহ মনসার চালি তৈরি হয় শোলা দিয়ে। এটা বর্ষাকালে বাংলায় অনুষ্ঠিত কোনো নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের প্রাকৃতিক-জৈবিক চিহ্ন বা টোটেমের উপাসনা। এছাড়াও শোলা দিয়ে নানা আচারমূলক গুরুত্ব রয়েছে এমন বহু জিনিস তৈরি হয়। যেমন, সাইটল, যা উত্তরবঙ্গের আদিবাসী সম্প্রদায়ের দেবী সাইতোরির উদ্দেশ্যে নিবেদিত হয়। কিংবা মাশান, এটা একটা আত্মা, কোচবিহার এবং আলিপুরদুয়ার জেলার রাজবংশী সম্প্রদায়ের মানুষরা যার পূজা করেন।

আচারমূলক তাৎপর্য আছে এমন জিনিস তৈরি করা ছাড়াও শোলাশিল্পীরা এখন শোলা দিয়ে ফুলদানি, ওয়াল হ্যাঙ্গিং, টেরাকোটা সামগ্রীর অঙ্গসজ্জা, রথের ত্রিমাত্রিক রিলিফের কাজ, দেবদেবীর মূর্তি, কাচের বোতলে শোলার ক্ষুদ্র হস্তশিল্প এবং পর্যটন কেন্দ্রগুলিতে তাজমহল, মুর্শিদাবাদের হাজারদুয়ারির মতো স্মারক তৈরি করছেন। অন্যান্য সামগ্রীগুলির মধ্যে রয়েছে শোলার মুখোশ, রাস ফুল, ঝাড়া, শোলার হাতি, ময়ূরপঙ্খী নৌকা, মালা, খেলনা, ফুল, সবজি, অলঙ্কার, শোলার ফুলের হেয়ার ক্লিপ, নানা ধরনের ফুলের গুচ্ছ ইত্যাদি। হাওড়াতে তৈরি হয় শোলার ময়ূরপঙ্খী নৌকো। নিজেদের পণ্যগুলিকে সমসাময়িক করার জন্য শোলাশিল্পীরা বানাচ্ছেন যিশুর মূর্তি, নৌকা এবং আরও অনেক কিছু।

পুনরুজ্জীবনের কাহিনি
পশ্চিমবঙ্গের শোলা শিল্প রাজ্যের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত থাকলেও বিলুপ্ত হতে চলেছে। দক্ষ শিল্পীদের সংখ্যা খুবই কম, নতুন প্রজন্মের অনাগ্রহ, শোলা পণ্যের বদ্ধ এবং মরশুমি বাজার, পণ্যসামগ্রীর কম দাম শোলা শিল্পের ঐতিহ্য হারিয়ে যাওয়ার প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে।

বাংলার রুরাল কালচারাল ক্রাফট হাব বা আরসিসিএইচ প্রকল্প শোলা শিল্পের ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবনের একটা অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। উৎপাদন এবং বিপণনের নতুন সম্ভাবনাগুলিকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, যেখানে শিল্পীরা তাঁদের উদ্ভাবনী পণ্যগুলিকে নিয়ে এখন পৌঁছচ্ছেন জাতীয় ও বিশ্ব বাজারে। ঐতিহ্যবাহী শিল্পগুলি সম্পর্কে সচেতনতাও বেড়েছে এবং তা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগুলিকে রক্ষা করার ব্যাপারে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তবুও এটা মানতেই হবে বাঙালি জীবনে শোলার ব্যবহার এখন আগের তুলনায় অনেক কমেছে। তবে শিল্পগুণ ও ঐতিহ্যের নিরিখে এই হালকা সামগ্রীর ওজন কিন্তু মোটেই কমেনি।


সাবস্ক্রাইব
অবহিত করুন
guest
0 টি মন্তব্য
ভোটপ্রাপ্তি অনুসারে
নতুন থেকে পুরোনো পুরোনো থেকে নতুন
ইনলাইন প্রতিক্রিয়া
সকল মন্তব্য দেখুন
Scroll to Top