তালিকা

আধুনিক বাঙালির ফেভারিট লোকেশ
নববর্ষ : সেদিন এদিন


নববর্ষ, মানে নতুন বাংলা বছরের প্রথম দিনটা, ছোটোবেলায় আমাদের কাছে খুব একটা আলাদা চেহারা নিয়ে আসত বলে কই মনে তো পড়ে না। থাকতাম কলকাতার কাছেই একটা মফস্বল শহরে। কলকাতার সঙ্গে সেই জায়গার যোগ ছিল খুবই ঘনিষ্ঠ। কিন্তু তার মধ্যেই কোথায় যেন একটা আলাদা হবার প্রবণতাও কাজ করত ভেতরে ভেতরে। নতুন বছরের গোড়ার দিনটা বাড়িতে ছুটির দিন বলেই ধরা হত দেখতাম। টুকটাক একটু অন্যরকম খাওয়া-দাওয়া হত ঠিকই, কিন্তু সে তো বড়োদের ছুটির অবসর বলেই প্রধানত। এখনকার মতো বেজায় গরম পড়ে যেত পয়লা বৈশাখের আগে থেকেই, ফলে আমাদের হুটহাট বাড়ি থেকে বেরোনোর অনুমতি মিলত না মোটেই। বেরোতে হলে বাড়ির বড়দের অনুমতি নিয়ে, তাদের সঙ্গে। ফলে বাড়তি মজার অবকাশ আর কোথায়, যেটা মিলত রথের দিন বিকেলে মেলায় যাবার নাম করে, বা পুজোর দিনগুলোয়। আলাদা বলতে বিকেলে বাবা-কাকাদের মধ্যে কারো একটা সঙ্গে বেরিয়ে কয়েকটা দোকানে ঘুরে আসা, ব্যাস। দেখতাম ওঁরা দোকানে গিয়ে টাকা-পয়সা দিতেন, ততক্ষণে এসে গেছে বরফ দিয়ে ঠান্ডা করা শরবতের গেলাস আর মিষ্টির বাক্স। শুনতাম ওইসব দোকান থেকে নাকি আমাদের সারা মাসের জিনিস আসে। সেসব জিনিসের নাম লেখা থাকত একটা খাতায়। পাশেপাশে সেই সব জিনিসের দাম। মাসের শেষে যা যা আনা হত সেসবের দাম মিটিয়ে দেওয়া হত। নববর্ষ মানে ওই দিনটায় আগের বছরের খাতাটাতে পাতা ফাঁকা থাকলেও তা বাতিল করে আসত নতুন খাতা। বাতিল হলেও খাতাটা কিন্তু ফেলে দেওয়া হত না মোটেই, রাখা থাকত। এরকম তিন-চার বছরের খাতা সামনে নিয়ে মাঝে মধ্যে বাবা-কাকাদের মধ্যে গভীর গভীর সব আলোচনা আসর বসে যেত। কথা হত যত দিন যাচ্ছে কীরকম জিনিসের দাম বেড়ে যাচ্ছে, তাই নিয়ে। প্রবল বিচিত্র সব পরিকল্পনা হত খরচ কমানো নিয়ে। সেসব পরিকল্পনা কার্যকরী হত না মোটেই, কিন্তু বিস্তর তর্ক-বিতর্ক হত সেই নিয়ে। আলোচনা হত বিস্তর, কিন্তু খরচ কখনো কমত না। এসব বোঝা যেত যখন এই নিয়ে মা-কাকিমা-ঠাকুমারা বকুনি খেতেন। তাঁরাও তখন আলোচনায় থাকতেন এবং যে যার কথা বলতেন। এবং প্রশ্ন উঠত খরচ কমাতে বলা হলেও জিনিস ব্যবহারে সংসারের কেউই রাশ টানতে পারছেন না কেন, তা-ই নিয়ে তখন আলোচনা শুরু হত কেন পারা যাচ্ছে না তা-ই নিয়ে। তখন আলোচনার মোড় ঘুরে যেত এবং মা-ঠাকুমারা বীর বিক্রমে যে যার কাজে চলে যেতেন।

আরেকটা জিনিস মনে পড়ে নববর্ষ বললেই। নতুন বছর শুরুর আগে বাড়িতে আসত একটি মোটা মতন লালচে রংয়ের বই। নাম শুনতাম পাঁজি। তাতে খুব রহস্যময় ভাষায় নাকি দিনক্ষণের সব বিবরণ থাকত। এই বইয়ের উপর বাড়ির সবাই খুব বিশ্বাস রাখতেন দেখতাম। প্রায়ই খুলে কী সব দেখে নেওয়া হত। আমাদের, মানে ছোটোদের ও-বইতে হাত দেওয়া মানা ছিল। লুকিয়ে চুরিয়ে দেখতে পেলেও বইটার মাথামুণ্ডু বুঝতাম না। তবে অবাক লাগত বইয়ের পাতায় বিশাল বিশাল বাঁধাকপি আর নানা রকম অদ্ভুত জিনিসের বিজ্ঞাপন দেখে।

পয়লা বৈশাখে খাওয়া-দাওয়ায় একটু বৈচিত্র্য আসত বটে, পদ বাড়ত, কিন্তু সেসব খুবই সাধারণ, আর খাওয়া হত সাধারণভাবেই একটু দেরিতে। প্রথমে বসত ছোটোরা। তারপর প্রবল আড্ডা সহযোগে বড়োরা। মা-কাকিমারা বসতেন তারপর। তখনো যথেষ্ট আড্ডা চলত, কিন্তু তার ধরন যেত বদলে। তারপর বড়োরা কেউ ঘুমিয়ে নিতেন ঘন্টাখানেক আর কেউ মজে যেতেন গল্পে। এই একটা দিন এসব গল্পের আসরে আমাদের, ছোটোদের উপস্থিতি নজর করা হত না।

প্রচুর প্ল্যান হত বেড়াতে যাবার, যা আদৌ বাস্তবে ঘটতে দেখতাম না। বা দেখলেও কমই দেখতাম। এবং সেইসব বেড়ানোর দৌড় ছিল হয় নানান আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি কিংবা বড় জোর পুরী কিংবা খুব দূর হলে বেনারস। আর এসব বেড়ানোর দৈর্ঘ্য ছিল খুব বেশি হলে ৭ থেকে ১০-১২ দিন। এবং এই বেড়ানোগুলো হতো সাধারণত বর্ষাকালটা কেটে গিয়ে শরৎকাল এলে কিংবা শীতে । কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই এইসব আলোচনাগুলো আরম্ভ হতো এই নববর্ষে কিংবা তার কাছাকাছি সময়। যত সময় ঘনিয়ে আসত আলোচনার আসর বসত ঘনঘন। আসরে চা আসত বড় ট্রেতে করে। ট্রে পৌঁছে দিত বাড়ির একমাত্র কাজের মানুষ বিশ্বনাথ। তার কাছ থেকে আলোচনার অংশবিশেষ শুনে নিতাম আমরা, ছোটরা । বেড়াতে বেরোলে সেও থাকত সঙ্গে। ছোটদের দেখভালের দায়িত্ব থাকত তার ওপরেই।

মফস্বল থেকে তারপর চলে এসেছি কলকাতায়। সেদিনের সেই দোর্দণ্ড প্রতাপ বড়োরাও নেই অনেকেই। সেই বিশ্বনাথও নেই। ব্লাড ক্যান্সারে মারা গেছে আমাদের বাড়িতে থাকাকালেই। একেবারে আমাদের চোখের ওপরে। দিন বদলেছে। মানুষগুলোর বয়স বেড়েছে। যৌথ পরিবার ভেঙে গেছে। সেদিনের সেই সব প্রতিবেশীরাও নেই। যৌথ পরিবারের একেক জন একেক জায়গায় ছড়িয়ে গেছে। কাজের সূত্রে কেউ আবার বিদেশেও। বছরে-দু'বছরে এক-আধবার দেখা হয় কি হয় না। কিন্তু নতুন বছর আজও আসে। পয়লা বৈশাখ আসে। কিন্তু পাঁজি আসে না আর। এলেও সে-বইয়ের আর সেই সম্মান আর গুরুত্ব নেই। পয়লা বৈশাখের কয়েকদিন বাদেই আচার তৈরির তোড়জোড়ও আরম্ভ হয় না। বড়ি দেবার জন্য ব্যবস্থাও হয় না। কিন্তু পয়লা বৈশাখ শব্দটার সঙ্গে মাখামাখি হয়ে থাকা এক ধরনের উৎসব উৎসব গন্ধ বেরোয় ঠিক। কোনো কোনো বছরে এই দিনটায় টুক করে বেরিয়ে একলাই ঘুরে আসি সেই মফস্বল থেকে। বাড়িটা এখনও আছে আমাদের। কিন্তু চেনা সেই আলোছায়াটা নেই। একটু দাঁড়িয়ে থাকি, তারপর ফিরে আসি। চেনা মানুষগুলোর সঙ্গে সঙ্গে সেই সময়টাই আসলে কোথায় হারিয়ে গেছে।


সাবস্ক্রাইব
অবহিত করুন
guest
0 টি মন্তব্য
ভোটপ্রাপ্তি অনুসারে
নতুন থেকে পুরোনো পুরোনো থেকে নতুন
ইনলাইন প্রতিক্রিয়া
সকল মন্তব্য দেখুন
Scroll to Top