তালিকা

আধুনিক বাঙালির ফেভারিট লোকেশ
বাংলা নববর্ষ উদযাপন বদলে গেছে আমূল


আমাদের ছোটোবেলায় বাংলা নববর্ষ মানেই হালখাতাকে বোঝাত। সন্ধ্যা নামলেই পাড়ায় পাড়ায় আলো ঝলমল বৈভব নেমে আসত। আর বাবার হাত ধরে দোকানে দোকানে পৌঁছতাম হালখাতা করতে। পাড়ার নিত্য প্রয়োজনীয় মনোহারী দোকানটিও সাজানো হত উজ্জ্বল আলোয়। অন্যদিন মলিন বসন পরে যে দোকানদার তাঁর দোকান সামলাতেন তিনি সেদিন নতুন জামা কাপড়ে সজ্জিত হয়ে অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত থাকতেন। দোকানে গেলেই মিলত ক্যাওরা দেওয়া শরবত আর মিষ্টির প্যাকেট। আর একটু বেশি রাতে হিসেবে বসতাম -- কটা দোকানে হালখাতা করতে যাওয়া হল। কটা মিষ্টির প্যাকেট মিলল।

আরও আগের কথায় একটু ঘুরে আসি। কলকাতা তখন হোয়াইট টাউন আর ব্ল্যাক টাউন এই দুভাগে বিভক্ত। হোয়াইট টাউনে থাকতেন সাহেব সুবোরা। আর ব্ল্যাক টাউনে নিছক ছাপোষা বাঙালিরা। এই একটি দিনে, অর্থাৎ পয়লা বৈশাখে সব বিভেদ ঘুচে যেত। ব্ল্যাক টাউনের রায়সাহেব, রায়বাহাদুরদের বাড়ি থেকে হোয়াইট টাউনের সাহেব বাড়িতে ঝাঁকায় করে ভেট যেত -- নানা ধরনের ফলমূল, কাজু - পেস্তা - আখরোটের সঙ্গে মাটন আর ওয়াইনেরও একটা বোতল। সেদিন সাহেব তাঁর আভিজাত্য ভুলে বাবুর সঙ্গে বৌবাজারে যেতেন নিকি বাইজির গান শোনার জন্যে। বাবুর চুনোট করা ধুতি মাটিতে লুটোত। বাবু চিৎকার করে বলতেন -- ব্লান্ডি পানি লে আও।

মোট কথা সে বড়ো সুখের দিন ছিল। পয়লা বৈশাখ তখনও ইভেন্টে পর্যবসিত হয়নি। বাঙালি বাড়িতে বচ্ছরকার প্রথম দিনটিতে ভালো মন্দ রাঁধার রেওয়াজটি তখনও ছিল। মোচার ঘন্ট কিংবা পোস্তর বড়ার সন্ধানে রেস্তোরায় ছোটার দিন তখনও আসেনি। নতুন জামাকাপড় তখন মিলত নতুন বছরে। আমাজন - ফ্লিপকার্টের ক্যাটালগে চোখ রাখতে বাঙালি তখনও শেখেনি, সুইগি-জোমাটো তো তখন স্বপ্নের দুনিয়া। ময়দানে তখন থেকেই রেওয়াজ বার পুজোর। ফি বছর কলকাতা ময়দানে বার পুজোর মাধ্যমে নতুন ফুটবল মারশুমের সূত্রপাত হয়। বাঙালির সব গিয়াছে -শুধু বোধহয় এই ফুটবলটুকুই অবশিষ্ট আছে। আজও ময়দানে পয়লা বৈশাখ বার পুজো হয়। দলের অধিনায়ক কিংবা সচিব ধুতি পাঞ্জাবিতে সজ্জিত হয়ে বারের ওপর সংকল্প করেন। বারপোস্টে লাগে তেল, সিঁদুর। কোথাও ভিয়েন বসে। লুচি আলুরদম আর পান্তুয়া। কোথাও আবার প্যাকেট। খাস্তার গন্ধে ময়দান ম ম করে। মালিদের এদিন নতুন বস্ত্র দেওয়া হয়। আজও সেই সমানে চলছে। বাঙালি যতদিন থাকবে তার ফুটবলও বোধহয় থেকেই যাবে।

পয়লা বৈশাখ আগে বাংলা ছবিও মুক্তি পেত। মিনার - বিজলী - ছবিঘর কিংবা শ্রী - প্রাচী - ইন্দিরা মুখরিত হত। আজ আর সেই দিন নেই। শ্রী-প্রাচীই আর নেই। সেখানে বড়ো বড়ো শপিং মল মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। আসলে বাঙালি যত এগিয়েছে তত বেশি বিসর্জিত হয়েছে পুরোনো সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য। তাই পয়লা বৈশাখ আজ বিবর্ণ। নিউ ইয়ার্স ইভে আজ পার্ক স্ট্রিটের পান শালায় বসে চিয়ার্স বলার লোকের অভাব নেই, হাতিবাগান কিংবা গড়িয়াহাটের চৈত্র সেল আজ বর্ণহীন। স্বাভাবিক। লোকে বলবেন কিছু পেতে গেলে কিছু বোধহয় হারাতে হয়। কিন্তু পাওয়ার পাল্লা ভারি, নাকি হারানোর - সেই হিসাব কে নেবে !


সাবস্ক্রাইব
অবহিত করুন
guest
0 টি মন্তব্য
ভোটপ্রাপ্তি অনুসারে
নতুন থেকে পুরোনো পুরোনো থেকে নতুন
ইনলাইন প্রতিক্রিয়া
সকল মন্তব্য দেখুন
Scroll to Top