তালিকা

আধুনিক বাঙালির ফেভারিট লোকেশ
বাংলা নববর্ষ নিয়ে সামান্য কথা



বাংলা নববর্ষ কবে থেকে পালন করা শুরু হয়, কে বাংলা নববর্ষ বা বাংলা বর্ষ গণনা শুরু করেন--এ নিয়ে কিছু বিতর্ক শুরু হয়েছে। বাংলা মুসলিম মৌলবাদী শক্তি ফতোয়া দিচ্ছে, পয়লা বৈশাখ চলবে না, এটা নাকি মুসলমানি ব্যাপার নয়। আর ভারতে বসে হিন্দু অপধর্ম ক্ষমতা ব্যবসায়ীদের নিদানপত্র-- বাংলা নববর্ষ নয়, একে বলতে হবে, হিন্দু নববর্ষ। তবে মজার বিষয়, 'হিন্দু' শব্দটাই 'হিন্দু' নয়। ফার্সি। আর যাদের হয়ে এই নিদান, তাদের মাথা, ভারতের 'সঙ্ঘ' পরিবারের 'সঙ্ঘ' শব্দটাও সংস্কৃত নয়, পালি, যা মূলত বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থে ব্যবহৃত।

বাংলা নববর্ষ কেবল নয়, হিন্দু মুসলিম দুই মৌলবাদীদের আপত্তির জায়গা বহু ক্ষেত্রেই এক। ভাষাটা কেবল ইষৎ ভিন্ন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে দু পক্ষই সমানে গালি দেন ও পাঠ্যপুস্তক থেকে দু-দেশেই তাঁর লেখা পাঠ্যপুস্তক থেকে সরে বাদ যায় এদের বিপরীত চাপে।

ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় লিখেছেন : বৈদিক যুগে বছরের প্রথম মাস হিসেবে ধার্য হয় অগ্রহায়ণ। অঘ্রাণ মাসেই নবান্ন হত। মুর্শিদকুলি খাঁ যখন বাংলার শাসক তখন খাজনা আদায়ের জন্য ধার্য হয় বৈশাখ মাস। নববর্ষ পালনের হোতা পৃথিবীতে ইরানিয়রা।। ফার্সি নওরোজের জাঁকজমকে অভিভূত ইউরোপ পরে গ্রেগরিয়ান দিনপঞ্জি অনুসারে পয়লা জানুয়ারি পালন শুরু করে। ভারতে নববর্ষ পালনের রেওয়াজ শুরু মুঘল আমলে। ফার্সি নওরোজের আদলে ধুমধাম করে রাজধানী দিল্লি ও সুবেগুলোতে নববর্ষ উৎসব উদযাপন শুরু হল। আর আকবরের আমলে হোলি নববর্ষ উৎসব আলাদা মাত্রা গ্রহণ করে। ভূমিসংস্কার করেছিলেন শের শাহ, আকবর এগোলেন রাজস্ব সংস্কারে। ভূমি মাপ, ভূমি ও কৃষি রাজস্ব আদায়ে আইন তৈরি করতে সাহায্য করেন তোডরমল। এখন বছরে একটা নির্দিষ্ট দিন চাই খাজনা আদায়ের। আরবি হিজরি অনুযায়ী সম্ভব নয়। দিন নির্দিষ্ট থাকে না চান্দ্র বর্ষে। তাই সৌর বর্ষের সন্ধান।

১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলা নববর্ষের দিনক্ষণ নির্ধারিত হল। দিনক্ষণ নির্ধারণ করলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তক ফতেউল্লাহ্ সিরাজি। হিজরি সনের ভিত্তিতে তৈরি হল সন-এ-ইলাহি। ভিত্তিবর্ষ হল হিজরি সন, আদতে যা ৫৯৩ খ্রিস্টাব্দ। এর নাম কেউ বলেন সন, কেউ সাল, কেউ বঙ্গাব্দ।

সন আরবি শব্দ, সাল ফার্সি শব্দ। বঙ্গাব্দ বাংলা।


খ্রিস্টাব্দ থেকে বাংলায় পৌঁছাতে একটা সহজ নিয়ম চাইলে অনুসরণ করতে পারেন। ৭ বছর, ৩ মাস ১৭ দিন বিয়োগ করলে সাধারণত মেলে। তবে সবচেয়ে ভালো উপায় সাধারণ শতক তথা খ্রিস্টাব্দ থেকে ৫৯৩ ( ক্ষেত্রবিশেষে ৫৯৪) বিয়োগ করা।




বাংলায় নববর্ষ নানা নামে প্রচলিত ছিল বা আছে। পুণ্যাহ, হালখাতা, বৈশাখী মেলা, চট্টগ্রাম অঞ্চলে বলী খেলা ইত্যাদি। 'পুণ্যাহ' জমিদারদের খাজনা আদায়ের দিন। সারা বছর ধারে কেনাকাটা করে ধার শোধ করার উৎসব হালখাতা। ওইদিন হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে দোকানদার আমপাতা দিয়ে দোকান সাজান। ধূপ জ্বালান। কেউ কেউ ধুনো দেন। একটা লালখাতায় জমা পড়া টাকার পরিমাণ লেখা হয়। একটা মিষ্টির প্যাকেট দেওয়া হয়। কোথাও কোথাও লুচি তরকারি আয়োজন থাকে। কেউ কেউ বসিয়ে খাওয়ান। আর ইদানীং দেওয়া হয় ক্যালেন্ডার। এই ক্যালেন্ডার আবহমান বাংলার মিশ্র সংস্কৃতিকে তুলে ধরে। হিন্দু বা মুসলিম যে দোকানদারই হোন দুই সম্প্রদায়ের কথা মাথায় রেখেই ক্যালেন্ডার করেন। হিন্দু মুসলিম দুই ধর্মের প্রতিষ্ঠানের ছবি থাকে। আমাদের ছোটোবেলায় একটা ক্যালেণ্ডার ছিল খুব 'কমন' -- কাজী নজরুল ইসলামের ছবি দিয়ে তলায় লেখা -- ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি ! আর থাকত হৃষ্টপুষ্ট শিশুর মুখ। রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীর মুখ দেখিনি। ব্যতিক্রম সুভাষচন্দ্র বসু। ঘোড়ায় চড়া সুভাষ থাকতেন। তবে নজরুল ইসলামের চেয়ে বেশি জনপ্রিয় কেউ ছিলেন না।

প্রখ্যাত লোকসংস্কৃতি গবেষক শামসুজ্জামান খান লিখেছেন--'বাংলা নববর্ষের আর একটি প্রধান অনুষ্ঠান হল বৈশাখী মেলা। দেশের বিভিন্ন স্থানে বৈশাখের প্রথম দিনে বার্ষিক মেলা বসে। এইসব মেলার অনেকগুলোই বেশ পুরনো। এই মেলাগুলোর মধ্যে খুব প্রাচীন ঠাকুরগাঁ জেলার রানিশংকৈল উপজেলার নেকমরদের মেলা এবং চট্টগ্রামের মহামুনির বৌদ্ধপূর্ণিমা মেলা। এক সময়ে এইসব মেলা খুব ধুমধামের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হত। সে-মেলা এখনো বসে, তবে আগের সে জৌলুস এখন আর নেই।

আগে গ্রাম-বাংলার এই বার্ষিক মেলাগুলোর গুরুত্ব ছিল অসাধারণ। কারণ তখনও সারাদেশে বিস্তৃত যোগাযোগ ও যাতায়াত ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। ফলে মানুষের জীবনযাত্রা ছিল স্থবির। এখন যেমন দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে এক দিনের বেশি লাগে না, আগে তা সম্ভব ছিল না। নৌকা, ঘোড়ার গাড়ি, গরুর, মোষের গাড়িতে মানুষ বা পণ্য পরিবহণে , বহু সময় এমনকি কোথাও আবার কয়েকদিনও লেগে যেত। এখন নতুন নতুন পাকা রাস্তা ও দ্রুতগতির যানবাহন চালু হওয়ায় সে-সমস্যা আর নেই। আগে এইসব আঞ্চলিক মেলা থেকেই মানুষ সারা বছরের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে রাখত। তাছাড়া এইসব মেলা অঞ্চল বিশেষের মানুষের মিলন মেলায়ও পরিণত হত। নানা সংবাদ আদান-প্রদান, নানা বিষয়ে মত বিনিময়েরও আদর্শ স্থানও ছিল এইসব মেলা। আবার বাৎসরিক বিনোদনের জায়গাও ছিল মেলা। মেলায় থাকত কবিগান, কীর্তন, যাত্রা, গম্ভীরা গান, পুতুল নাচ, নাগর দোলাসহ নানা আনন্দ-আয়োজন।

নববর্ষে ওই তিনটি প্রধান সর্বজনীন উৎসব ছাড়াও বহু আঞ্চলিক উৎসব আছে। এদের মধ্যে চট্টগ্রামের লালদিঘি ময়দানে অনুষ্ঠিত বলী খেলা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ১৯০৭ সাল থেকে কক্সবাজারসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামের নানাস্থানে এই খেলার প্রচলন হয়। বিখ্যাত কুস্তি খেলাকেই বলা হয় বলী খেলা। আবদুল জব্বার নামে এক ব্যক্তি এ খেলার প্রবর্তন করেন বলে একে ‘জব্বারের বলী খেলা’ বলা হয়।


পান্তাভাত খাওয়ার একটা প্রচলন ঢাকায়, কলকাতায় আছে। এর মূলে আছে কৃষকদের আমানি খাওয়ার প্রথা। শামসুজ্জামান খান লিখেছেন, আমানিও নববর্ষের একটি প্রাচীন আঞ্চলিক মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান। এটি প্রধানত কৃষকদের পারিবারিক অনুষ্ঠান। চৈত্র মাসের শেষদিনের সন্ধ্যারাতে গৃহকর্ত্রী এক হাঁড়ি জলে স্বল্প পরিমাণ অপক্ব চাল ছেড়ে দিয়ে সারারাত ভিজতে দেন , আর তার মধ্যে একটি কচি আমের পাতাযুক্ত ডাল বসিয়ে রাখেন। পয়লা বৈশাখের সূর্য ওঠার আগে ঘর ঝাড়ু দিয়ে সেই হাঁড়ির জল সারা ঘরে ছিটিয়ে দেওয়া হয়। পরে সেই ভেজা চাল সকলকে খেতে দিয়ে আমের ডালের কচি পাতা হাঁড়ির জলে ভিজিয়ে বাড়ির সকলের গায়ে ছিটিয়ে দেওয়া হয়। তাঁদের বিশ্বাস এতে বাড়ির সকলের কল্যাণ হবে। নতুন বছর হবে সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধির।

এছাড়া চট্টগ্রাম অঞ্চলে ছিল বৈসাবী উৎসব। পার্বত্য বৈসুব, সাংগ্রাই ও বিজু তিনটিকে একত্র করে ‘বৈসাবী’ । 'গ্রাম-বাংলায় নববর্ষে নানা খেলাধুলারও আয়োজন করা হত। মানিকগঞ্জ মুন্সীগঞ্জে হত গরুর দৌড়, হাডুডু খেলা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মোরগের লড়াই, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা, নড়াইলে ষাঁড়ের লড়াই প্রভৃতি।

এটা পূর্ববঙ্গের বৈশিষ্ট্য। পশিচমবঙ্গে ছিল ৩০ চৈত্র শিবের গাজন বা চড়কের মেলা। লোকে সাত বা তিনদিনের জন্য সন্ন্যাসী সাজত। ঝাঁপ দিত, কাঁটার ওপর দিয়ে হেঁটে যেত, আগুনের মধ্য দিয়ে লাফ দিয়ে পার হত, পিঠে কাঁটা ঝুলিয়ে শূন্যে ঘুরত। আমাদের গ্রামে উঁচু থেকে ঝাঁপ দিত, পুকুরে স্নান করে আধ কিমি রাস্তা দন্ডি কেটে কেটে ফিরত। তারপর ঝাঁপ দেওয়ার আগে ডাব ছুঁড়ত । সেই ডাব কাড়তে হুড়োহুড়ি পড়ত। যারা দল পাকিয়ে বেশি ডাব কাড়তে পারত তারা নায়কের সম্মান পেত। হিন্দু মুসলমান মিলেই দল গড়া হত।


রবীন্দ্রনাথ প্রথম নাগরিক জীবনে পয়লা বৈশাখকে অন্যভাবে সঞ্চারিত করেন। পয়লা বৈশাখের পর জলাভাবের কারণে শান্তিনিকেতনে ছুটি দেওয়া হত। সে জন্য পঁচিশে বৈশাখের বদলে পয়লা বৈশাখ নাচ গান কবিতায় উদ্বেল হয়ে উঠত শান্তিনিকেতন। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে ফজলুল হক সরকার গঠন করে প্রথম পয়লা বৈশাখে ছুটি ঘোষণা করেন। পরে পাকিস্তান সরকার তা বাতিল করে। আমাদের রাজ্যেও একুশের প্রথম দশকে পয়লা বৈশাখের ছুটি দেওয়া হয়নি। পরে হইচই করায় ছুটি ফেরে। পয়লা বৈশাখের পরের দিন এ-রাজ্যে উচ্চমাধ্যমিক ও একাদশ শ্রেণির পরীক্ষা হয়। যেমন হয় ইদের পরদিন।

১৯৬৭ থেকে বাংলাদেশের রমনা ময়দানে শুরু প্রতিবাদী পয়লা বৈশাখ। আজ তা ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পেয়েছে। এ-রাজ্যে ভাষা ও চেতনা সমিতি ১৯৯৯ থেকে সারাদিন টানা ১২ ঘন্টা জাতীয় নববর্ষ উৎসব। এটা আর কোথাও হয়না। বিরতিহীন ১২ ঘন্টা উৎসব। তবে বাংলাদেশের মঙ্গল শোভাযাত্রার কোনো তুলনা নেই। লাখ লাখ মানুষ নামেন পথে। ভালোবাসায় রঙিন হয়ে। নববর্ষ বাঙালির জাতীয় উৎসব। ধর্মের নামে এখন অপধর্মের প্রবল বাড়াবাড়ি। জাতপাত, ছোঁয়াছুঁয়ি, অস্পৃশ্যতা ফেরানোর অপচেষ্টা হচ্ছে, রাজনৈতিক হানাহানি বাড়ছে, সে-সময় একসঙ্গে বসে খাওয়া, গান গাওয়া, পথ চলা, মতের আদানপ্রদান খুব জরুরি। আর এই কাজে নববর্ষ উদযাপন হোক ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদী মানুষের হাতিয়ার।


সাবস্ক্রাইব
অবহিত করুন
guest
0 টি মন্তব্য
ভোটপ্রাপ্তি অনুসারে
নতুন থেকে পুরোনো পুরোনো থেকে নতুন
ইনলাইন প্রতিক্রিয়া
সকল মন্তব্য দেখুন
Scroll to Top